ওশান নিউজ প্রতিবেদক : বাংলাদেশ রেলওয়ের চলমান সংকট, প্রশাসনিক জটিলতা ও কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) সকাল ১০টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির।বক্তারা বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ গণপরিবহন ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও এখনো তার পূর্ণ সম্ভাবনা অর্জন করতে পারেনি। একসময় এই খাত দেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাণশক্তি ছিল, কিন্তু বর্তমানে রেলওয়ে নানা সমস্যায় জর্জরিত। ইঞ্জিন বিকল, ট্রেন লেট, টিকিট ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা সবকিছু মিলিয়ে যাত্রীদের আস্থা দিন দিন কমে যাচ্ছে।
তারা আরও বলেন, রেলওয়ের অন্যতম বড় সমস্যা হলো ইঞ্জিন ও কোচ সংকট। নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাব এবং যন্ত্রাংশ সরবরাহে অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ঘন ঘন ইঞ্জিন বিকল হচ্ছে। এতে নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হয়, যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে, এবং রেলওয়ের রাজস্ব ক্ষতি হয়।
এ ছাড়া রেলপথ মন্ত্রণালয় ও রেলওয়ে অধিদফতরের মধ্যে দ্বৈত নেতৃত্ব কাঠামো সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। একাধিক দপ্তরের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নে দেরি হয়, ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও সংস্কার উদ্যোগ বছরের পর বছর ঝুলে থাকে।
বক্তারা বলেন, রেলওয়ের আরেক বড় সমস্যা হলো কর্মচারী ও তাদের পোষ্যদের অধিকার উপেক্ষা। দীর্ঘদিন ধরে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা পদোন্নতি, বেতন কাঠামো এবং সামাজিক সুরক্ষার ন্যায্য সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। কর্মচারীদের পরিবার বা পোষ্যদের নিয়োগ প্রক্রিয়াতেও অনিশ্চয়তা ও বৈষম্য বিদ্যমান। কর্মজীবনে তাদের পরিশ্রম ও অবদানের স্বীকৃতি না থাকায় কর্মীদের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ ও হতাশা তৈরি হচ্ছে। রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটির সভাপতি মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘রেলওয়ে কেবল একটি যানবাহন নয়, এটি হাজারো পরিবারের জীবন-জীবিকার কেন্দ্র। রেলওয়েকে টিকিয়ে রাখতে হলে আগে রেলকর্মীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। কর্মচারীদের কণ্ঠ যদি নীতিনির্ধারণে শোনা না যায়, তবে কোনো সংস্কারই সফল হবে না।
মনিরুজ্জামান মনির আরও বলেন, রেলওয়ের ডিপেন্ডেন্ট কোটা আইন করে সংরক্ষিত করতে হবে। কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পোষ্যদের সরাসরি নিয়োগ দেওয়া রাষ্ট্রের মানবিক ও নৈতিক দায়িত্ব। রেলওয়ে যদি দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের মতো এই মানবিক নীতিকে বাস্তবায়ন না করে, তাহলে অসংখ্য পরিবার চরম কষ্টে নিপতিত হবে।
তিনি অভিযোগ করেন, বর্তমানে রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা ২০২০ সংশোধনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও, এখনো সেই পুরনো বিধিমালা অনুসারে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এটি প্রশাসনিকভাবে অযৌক্তিক, নৈতিকভাবে বেআইনি এবং আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য।
সভায় জানানো হয়, রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তি বা অসম্পূর্ণ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রচার করা হয়, যা কর্মকর্তাদের মানহানিকর পরিস্থিতিতে ফেলে।
বক্তারা বলেন, অডিট আপত্তি মানেই দুর্নীতি নয় এটি অনেক সময় প্রশাসনিক ভুল বা ফাইলিং ত্রুটির কারণে হয়, যা পরবর্তীতে সমাধানযোগ্য। তাই যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদ প্রকাশ রোধে রেলওয়ে প্রশাসন, আইন বিভাগ ও গণমাধ্যমের মধ্যে সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানানো হয়।
বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি মনে করে, রেলওয়ের সংকট সমাধানের জন্য একক নেতৃত্ব কাঠামো, স্বচ্ছ প্রশাসন, পোষ্য কোটা আইনি সুরক্ষা, ডিজিটাল টিকিট ব্যবস্থাপনা এবং রেলভূমির নিজস্ব বাণিজ্যিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্পনির্ভর রেল নয়, বরং দায়িত্বশীল, মানবিক ও জনমানুষের আস্থার প্রতীক হিসেবে রেলওয়েকে পুনর্গঠন করা এখন সময়ের দাবি।
অন্যদিকে, রেলওয়ের বিশাল পরিমাণ ভূমি নানা অজুহাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাচ্ছে। হাজার হাজার একর জমি বাণিজ্যিক ব্যবহারে দেওয়া হলেও রেল নিজে সেই সম্পদ ব্যবহার করে আয় বৃদ্ধির উদ্যোগ নিচ্ছে না। অবকাঠামো উন্নয়ন বা রেলওয়ে পোষ্যদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও এই জমিগুলো কাজে লাগানো হচ্ছে না। ফলে রেলওয়ে একদিকে সম্পদ হারাচ্ছে, অন্যদিকে নিজস্ব আয়ের উৎসও সীমিত হয়ে পড়ছে ।